ফেসবুকে ‘লেখার’ জন্য দুই শিক্ষককে বরখাস্তের প্রতিবাদ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফোরামের

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘অনভিপ্রেত’, ‘উস্কানিমূলক’ বক্তব্য ও ছবি পোস্ট করায় দুই শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বুধবার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন স্বাক্ষরিত অফিস আদেশ প্রকাশ করা হয়।

দুই শিক্ষক হলেন, ময়মনসিংহের গফরগাঁও সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী জাকিয়া ফেরদৌসী এবং বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজের দর্শন বিভাগের প্রভাষক সাহাদাত উল্লাহ কায়সার।

একই সঙ্গে তাঁদের শোকজ করে বিভাগীয় কার্যক্রম গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ জন্য কেন তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে জানাতে নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফোরাম একটি বিবৃতি দিয়েছেন। যেখানে ৮১৭ জন শিক্ষক স্বাক্ষর করেছেন। শুক্রবার (২৭ মার্চ) গণমাধ্যমে পাঠানো ফোরামের প্রধান সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়।  

বিবৃতিটি মাল্টিনিউজটোয়েন্টিফোর পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলোঃ

“সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করোনা ভাইরাসের মোকাবেলায় প্রশাসনিক গাফিলতির বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করায় ময়মনসিংহের গফরগাঁও সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী জাকিয়া ফেরদৌসী এবং বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজের দর্শন বিভাগের প্রভাষক সাহাদাত উল্লাহ কায়সারকে গতকাল বুধবার সাময়িক বরখাস্ত করে আদেশ জারি করা হয়েছে (স্মারক নং ৩৭,০০,০০০০,০৬৮,২৭,০২২,২০২০-১৬৩; স্মারক নং ৩৭,০০,০০০০,০৬৮,২৭,০২৩,২০২০-১৬১)। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন স্বাক্ষরিত এক আদেশে তাদেরকে সাময়িক বরখাস্ত করে শোকজ করা হয়। ফেসবুক স্ট্যাটাসে এই শিক্ষকগণ সরকার বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বা ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে কোন বক্তব্য প্রদান করেননি, বরং প্রশাসনের একটি অংশ যারা নিজ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে যৌক্তিক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। গত বেশ কিছুদিন ধরে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় প্রস্তুতির ভয়াবহ ঘাটতির যে হতাশাজনক চিত্র ফুটে উঠেছে তাতে সমগ্র দেশবাসীও এই শিক্ষকগণের সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন না। জীবন বাজি রেখে দায়িত্ব পালন করা সকল ডাক্তার যেখানে অত্যাবশ্যকীয় ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (Personal Protective Equipment; PPE) পাননি, সেখানে সরকারি কর্মকর্তাদের PPE গায়ে দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি প্রদানের কারণে শুধু ওই শিক্ষকগণই নয় সমগ্র সচেতন নাগরিক সংক্ষুব্ধ হয়েছেন। উল্লেখ্য যে, একইদিনে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপ-সচিব স্বাক্ষরিত এক পরিপত্রে (স্মারক নং ৪৫,০০,০০০০,১৬১,৯৯,০০১,১৯-৯১) চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ডাক্তার ও নার্সদের বিরুদ্ধে শালীনতার সীমা অতিক্রম করে নজিরবিহীনভাবে হুমকি প্রদর্শন করা হয় যা পরবর্তীতে বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের দাবির মুখে প্রত্যাহার করা হয়।

আমরা মনে করি স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর এই নগ্ন হস্তক্ষেপ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তির উপর হামলার শামিল। সারাদেশ যখন COVID-19 (কোভিড-১৯) তথা করোনা ভাইরাস নিয়ে আতংকিত, সরকার সাধারণ মানুষদের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, ঠিক তখন সরকারি আমলাদের ব্যর্থতা ঢাকতে বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে এই দেশপ্রেমী শিক্ষকগণকে। প্রকৃতপক্ষে কারণ দর্শানো উচিত সেসকল দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলাগণকে যারা সময় পেয়েও প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারেননি। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হওয়ার আগে আমরা প্রায় ৩ মাস সময় পেয়েছিলাম। কিন্তু এই সময়ে ডাক্তারদের জন্য পর্যাপ্ত সার্জিকাল মাস্ক ও প্রটেকশন গিয়ার পর্যন্ত যোগাড় করা হয়নি। এমনকি বিদেশ ফেরতদের জন্য কোয়ারান্টিনের সুব্যবস্থাও করা হয়নি। যেখানে দেশের জনগণের সুখ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিতকল্পে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন সেখানে আমলাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রাষ্ট্রীয় সম্পদের চূড়ান্ত অপব্যবহার করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ দেশের সকল খাতকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছেন। আমলাতান্ত্রিক এই দুষ্টচক্রের কারণে সাধারণ জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হতে হতে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে করোনা ভাইরাস বিষয়ে গবেষণা করার কারণে ব্র‍্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মলয় কান্তি মৃধাকেও হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। দেশবাসীকে অনুরোধ করছি আসুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহবানে সাড়া দিয়ে ‘করোনা যুদ্ধে’ জয়লাভের জন্য স্ব-স্ব গৃহে অবস্থান করি ও সরকারের জারি করা স্বাস্থ্য নির্দেশ মেনে চলি।

আমরা অতিস্বত্তর এই প্রতিহিংসামূলক কারণ দর্শানো নোটিশ ও সাময়িক বরখাস্তের আদেশের প্রত্যাহার দাবি করছি। পাশাপাশি যারা দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে অবিবেচকের মতো আচরণ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে নিয়মমাফিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও জোড় দাবি জানাচ্ছি।”

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.