প্রতিবন্ধী বিপ্লবের রঙিন স্বপ্ন গবাদি পশুতে

পরিবার এবং সমাজের বোঝা না হয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে নিজেকে সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলছেন বগুড়ার বিপ্লব হোসেন। গবাদী পশু পালন করে তিনি ইতোমধ্যে হয়েছেন স্বাবলম্বী। নিজের উপার্জিত টাকা দিয়ে চালাচ্ছেন পড়ালেখার খরচ। একই সঙ্গে দরিদ্র কৃষক বাবার সংসারে কিছুটা অর্থের যোগানও দিচ্ছেন তিনি।

বিপ্লব বগুড়ার শেরপুর উপজেলার গাড়ীদহ ইউনিয়নের জয়নগর মধ্যপাড়া গ্রামের কৃষক ফজলুল হক প্রামানিকের ছেলে। তিনি শেরপুর উপজেলার একটি কলেজের ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।

জন্মগতভাবেই বিপ্লব প্রতিবন্ধী। দুই পা এবং দুই হাত তার পুরোপুরি বিকলাঙ্গ। হাটুতে ভর করে চলাচল করেন তিনি।

বিপ্লব জানান, প্রতিবন্ধী জীবন অনেক কষ্টের। এক সময় হতাশায় থাকলেও সেই হতাশা এখন আর নেই। কারণ এখন জানি ভবিষ্যৎ কিসে ভালো হবে। সেই পথেই হাটছি। গবাদী পশুর খামারই দেখাচ্ছে রঙিন জীবন।

বিপ্লব জানান, গত ৫ বছর আগে তিনি তার বাবার কাছে একটা বকনা গরু কিনে দেওয়ার দাবি করেন। পরে ৪০ হাজার টাকা খরচ করে তাকে একটা গরু কিনে দেন বাবা ফজলুল হক। এরপর বিপ্লব উপজেলা প্রাণী সম্পদ অফিসে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন গবাদি পশু পালনের। প্রশিক্ষণ থেকে জ্ঞান দিয়ে পালন করতে থাকেন গরুটি। এক সময় তার বাবার কিনে দেওয়া গরুটি বাচ্চা প্রসব করে। এরপর বাচ্চাটির বয়স কয়েক মাস হতেই তিনি বাছুরটি বিক্রি করে দেন। গরুর বাছুর বিক্রির টাকায় তিনি একটি ছাগল কেনেন। এরপরই তার শুরু হয় স্বপ্ন দেখা এবং স্বপ্নের বাস্তবায়ন হওয়া।

বর্তমানে বিপ্লবের খামারে দুটি গাভী এবং একটি বাছুর রয়েছে। এছাড়া ছাগল রয়েছে চারটি। তার খামারে থাকা গাভী দুটিকে শাহীওয়াল জাতের গরু দ্বারা ব্রিড করা হয়েছে।

বিপ্লব হোসেন বলেন, ‘গরু দুটো বাচ্চা প্রসব করলে প্রতিদিন দুধ বিক্রি করতে পারবো। এছাড়া বাছুর দুটো ষাড় হলে মোটাতাজা করে বিক্রি করতে পারবো। ছাগল তো একসঙ্গে অনেকগুলো করে বাচ্চা দেয়। তাতে আমার খামার ভরে যাবে। বাবার কাছে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনে নিয়েছিলাম। একটা বাছুর বিক্রি করে সেই টাকা উঠে গেছে। এছাড়া বর্তমানে আমার গোয়ালে সবমিলিয়ে ৫ লাখ টাকার গরু-ছাগল রয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর পরিমাণ আরও বাড়বে। যে কারণে বলতে পারি প্রতিবন্ধী হলেও আমাকে কারো কাছে হাত পাততে হবে না। বরং আমার খামারেই দুই চারজন ব্যক্তিকে মাসিক বেতনে চাকরি দিয়ে রাখতে হবে।’

গবাদি পশু পালনে আপনাকে বাড়ির কেউ সহযোগিতা করেন কিনা জানতে চাইলে বিপ্লব বলেন, ‘বাবা আমাকে সাহায্য করেন। গরু নিয়ে মাঠে যান। প্রাণীগুলোকে ঘাস কেটে দেন, খড় কেটে দেন। আমিও ছাগল নিয়ে মাঠে যাই। গরু ছাগলকে খাওয়াই।’

উপজেলা প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর থেকে সহযোগিতা করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার কোন প্রয়োজন পড়লে আমি সেখানে যাই। তারা আমাকে পরামর্শ দেন। ওষুধ দেন। আমাকে একটা প্রকল্পের আওতায় খামার বড় করার কথা বলেছেন।’

বিপ্লবের বাবা ফজলুল হক বলেন, ‘ছেলে জন্ম নেওয়ার পর ওকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় থাকতাম। কিন্তু সেই দুশ্চিন্তা এখন আর নেই। ও খামার করেছে। এখন দেখি আল্লাহ তার ভাগ্নে কি রেখেছেন।’

শেরপুর উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. রায়হান বলেন, ‘বিপ্লব একজন প্রাণী সম্পদ উদ্যোক্তা। ইতোমধ্যে আমরা বিপ্লবকে একটি প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করেছি। প্রকল্পে যেসব সুযোগ সুবিধা রয়েছে সেগুলো তিনি পাচ্ছেন। বিপ্লবের যে খামার রয়েছে সেটা বর্ধিত করার জন্য আমরা তাকে একটি প্রত্যয়ন দিয়েছি। ব্যাংকে অনুরোধ জানিয়েছি যাতে তাকে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়।

তিনি আরও বলেন, শুধুমাত্র বিপ্লব নন শেরপুর উপজেলায় বিপ্লবের মতো আরো প্রায় ১০০ জন প্রতিবন্ধী রয়েছেন যারা প্রাণী সম্পদের উদ্যোক্তা। যাদের ডাটাবেস তৈরি করা হয়েছে। তাদেরকে প্রতিনিয়ত উপজেলা প্রাণী সম্পদের পক্ষ থেকে কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। তারা যেন নিজেদের আর্থিকভাবে সাবলম্বী করতে পারেন এবং দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে এগিয়ে আসতে পারেন সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এছাড়া প্রতিবন্ধী ছাড়াও যেসব বেকার নারী-পুরুষ রয়েছেন তাদেরকেও প্রাণী সম্পদের উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরির চেষ্টা করছি আমরা। কারণ প্রাণী সম্পদ অল্প জায়গায় স্বল্প বিনিয়োগে একটি কর্মসংস্থানের জায়গা। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জায়গা। এমনকি তারা এর মাধ্যমে নিজেদের পরিবারকে সাপোর্ট দেওয়া জায়গাও তৈরি করতে পারেন।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.