পণ্যমূলের ঊর্ধ্বগতি: মিলছে না আয়ের সঙ্গে ব্যয়

নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে নাগরিক জীবন। ঢাকার জীবনযাত্রায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বছর শুরুতেই খরচের চাপ আসে জগদ্দল পাথরের মতো। বাড়িভাড়া, সন্তানের পড়াশোনার খরচ বাড়ে; সঙ্গে যোগ হয় মূল্যস্ফীতি কিংবা ভ্যাট-ট্যাক্স, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়া, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা সংক্রান্ত কারণে অতিরিক্ত পণ্যমূল্য। ফলে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলেতেই হিমসিম খায় নগরবাসী।

এদিকে, ভরা মৌসুমেও চালের দাম বেড়েই চলেছে। তেলের দাম বেড়েছে কদিন আগেই। সব মিলিয়ে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য নেই নগরবাসীর। বাধ্য হয়ে মধ্যবিত্তরাও মুখে মাস্ক পরে দাঁড়াচ্ছেন টিসিবির লাইনে। কাটছাঁট হচ্ছে দৈনন্দিন খাবারের মেন্যু। ফলের দামও অত্যন্ত চড়া। কিনে খাওয়ার সঙ্গতি নেই অধিকাংশ মানুষের।

নগরবাসী বলছেন, লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির ফলে চাহিদা মেটাতে পারছে না সাধারণ মানুষ। প্রতি কেজি চালের দাম এখন ৫০ থেকে ৮০ টাকা। সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের জন্য চাল কেনা কঠিন হয়ে পড়েছে। আটার দামও চড়া।

পণ্যের অত্যধিক মূল্যের কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। এরই মধ্যে সরকার শতাধিক পণ্যে ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে অনেক নিত্যপণ্য। কয়েকটি পণ্য-সেবায় শুল্ক-কর বাতিল করলেও অনেকগুলোকে এখনো বিদ্যমান। এতে আরেক দফা দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনেক পণ্যের দাম এরই মধ্যে বেড়ে গেছে।

বেড়েছে শিক্ষা উপকরণের দামও। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও ওষুধপত্র, চিকিৎসা সরঞ্জামসহ সবকিছুরই মূল্য সাধারণ মানুষের আওতার বাইরে বলা যায়। এসব কারণে নগরজীবনে টিকে থাকাই এখন বড় লড়াই।

মধ্যবিত্তরাও টিসিবির লাইনে: আশা আক্তার, সরকারি একটি সংস্থায় চাকরি করেন। তার স্বামী বেরসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত। দুই রুমের ছোট ফ্ল্যাটে বাস করছেন এক সন্তান নিয়ে। নিত্যপণ্যের খরচের সঙ্গে যোগ হয়েছে সন্তানের লেখাপড়ার খরচ, যা আয় তা দিয়ে চলে না। তাই অফিস শেষ করে টিসিবির ট্রাকসেলে লাইন ধরতে হয়। শেষের দিকে কোনো দিন চাল, কোনো দিন ডাল পান। বাকি পণ্য আগেই বিক্রি হয়ে যায়। পাঁচদিন ঘুরে তেল কিনতে পেরেছেন তিনি।

আশা বলেন, ‘এখন বেঁচে থাকার লড়াইয়ে আছি আমরা। সবজি বাদে অন্য কোনো নিত্যপণ্যই হাতের নাগালে নেই। চালের দাম আরও বেড়েছে। এসব দিক বিচার করলে বলতে পারি এই তো বেঁচে আছি…।’

আশা বলেন, ‘টিফিনে শিশুকে ডিম ছাড়াই নুডলস দেই। তারও একটা চাহিদা আছে, কিন্তু সব মেটাতে পারি না। যা আয়, তাতেই চলে যায় যদি সব কিছুর দাম কম হতো। টিসিবির লাইনে দাঁড়ালে অনেকে বলে, আপনি তো চাকরি করেন। এখন বাধ্য হয়ে মুখে মাস্ক দিয়ে রাখি যাতে কেউ চিনতে না পারেন।’

একই অবস্থা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হাসিবুল হাসানের। তিনি বলেন, ‘তেল, চাল-ডালসহ সব পণ্যের দাম বেশি। কোনটা কিনবো, না কিনলে রান্না হবে না। বাসায় শিশু আছে, মা-বাবা রয়েছেন। সবার মন রাখতে পারি না। বাবা গ্রাম থেকে এসেছেন কোনো কাজ করতে পারেন না। আমাদের আর্থিক টানাপোড়েন দেখে তিনি কয়েকবার টিসিবির লাইন থেকে পণ্য এনেছেন। এটা খুব কষ্টের।’

জানতে চাইলে টিসিবির ডিলার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ট্রাকসেলে ৩৫০ জনের জন্য পণ্য থাকে, সে তুলনায় ক্রেতার সংখ্যা বেশি। এতে সবাইকে পণ্য দেওয়া সম্ভব হয় না। অনেক ভালো ভালো (মধ্যবিত্ত পরিবার) মানুষ আসেন, যারা মুখ ঢেকে পণ্য নেন। মুখ আড়ালে রাখেন, দেখেই বুঝতে পারি কষ্টটা কত।’

নিত্যপণ্যের অর্থ জোগাতে খাবার তালিকা থেকে মাছ-মাংস ছেঁটে ফেলছেন অনেকে। মিরপুরের কালশীতে থাকেন আবির হোসেন। মতিঝিলের একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। মাঝে মধ্যে কারওয়ান বাজার থেকে সন্ধ্যার দিকে কম দামের পণ্য (সবজি) কিনে নেন বাসার জন্য। দিন চলে যায়, তবে মাসে জোটে না মাংস। সবশেষ কবে গরুর মাংস কিনেছেন তা ভুলেই গেছেন।

আবির বলেন, ‘এখন যা আয় সে তুলনায় ব্যয় অনেক বেশি। খরচ বাঁচাতে দূরে কালশীতে বাসা নিয়েছি, একটা সরকারি স্কুলে মেয়েটা পড়ছে। এখন মেট্রোরেলের কারণে বাসাভাড়া বেড়েছে, বাড়তি খরচ যাচ্ছে সেখানে। স্কুলের খরচ আর চাল-ডাল কিনতে গিয়ে মাসের টাকা শেষ। গরু-মুরগির মাংস আমার কাছে বিলাসীপণ্য। গরুর মাংস কবে কিনেছি মনে নেই। সব খরচ বাড়লেও বেতন তো বাড়ে না।’

বাসাবোর মাংস বিক্রেতা সুজন বলেন, ‘আমরা একসময় গরুর মাংস বিক্রি করেছি অনেক। সাধারণত শীতকালে গরু ও হাঁসের মাংসের চাহিদা বাড়ে। এখন তা কমে গেছে। দুটি গরু বিক্রি করেও শেষ করতে পারি না। মাংস বিক্রি না হলে শুকিয়ে যায়। এতে ওজনও কমে যায়। এখন আমরা লাভেও নেই আবার লোকসানেও নেই।’

একই অবস্থার কথা জানান মুরগি বিক্রেতারা। এ বিষয়ে ডেমরার আমুলিয়া এলাকার ব্যবসায়ী দুলাল বেপারী বলেন, ‘আমাদের দোকানে মুরগি বিক্রি আগের মতো নেই। এখন অর্ধেকে নেমেছে।’

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.