ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে ‘ভালো মশা’

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে উলবাকিয়া মশা। এটিকে ‘ভালো মশা’ হিসেবেও অভিহিত করছেন আন্তর্জাতিক গবেষকরা।

মূলত ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করতে গবেষকরা এই মশা তৈরি করেছেন। তারা বলছেন, উলবাকিয়া—সংক্রমিত এডিস ইজিপ্টি মশা ঢাকা শহরের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম।

উলবাকিয়া একটি প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া যা প্রজাপতি, ফলের মাছি এবং কিছু মশার দেহে স্বাভাবিকভাবেই থাকে কিন্তু এডিস মশায় থাকে না। এই ব্যাকটেরিয়া মানুষ বা প্রাণীকে সংক্রমিত করতে পারে না এবং কামড় বা সংস্পর্শের মাধ্যমেও এটি ছড়ায় না।

এডিস মশায় উলবাকিয়া প্রবেশ করিয়ে দুটি কৌশলে মশাবাহিত ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রথমটি হলো—দমন কৌশল, যেখানে শুধুমাত্র পুরুষ উলবাকিয়া মশা বা ‘ভালো মশা’ পরিবেশে ছাড়া হয়। এই পুরুষরা স্ত্রী মশার সঙ্গে মিলিত হয়, স্ত্রী মশার ডিম ফোটে না। ফলে মশার সংখ্যা কমে যায়। দ্বিতীয়টি হলো—প্রতিস্থাপন কৌশল, যেখানে পুরুষ ও স্ত্রী উভয় ‘ভালো মশা’ ছাড়া হয় এবং উলবাকিয়া-আক্রান্ত স্ত্রী মশারা প্রজন্মের পর প্রজন্মে এই ব্যাকটেরিয়া বয়ে বেড়ায় ও ছড়িয়ে দেয়।

তারা উলবাকিয়া আক্রান্ত বা আক্রান্ত নয় এমন পুরুষদের সঙ্গে মিলিত হলেও তাদের বংশধর উলবাকিয়া বহন করে এবং এভাবে শেষ পর্যন্ত বন্য মশাদের প্রতিস্থাপন করে। এই দুটি কৌশলই বিভিন্ন দেশে উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করেছে।

এই গবেষণা দলে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার কিউআইএমআর বার্গহোফার মেডিকেল রিসার্চ ইনস্টিটিউট (কিউআইএমআরবি), কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, আইসিডিডিআর,বি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) বিজ্ঞানীরা।

গবেষণাটি সম্প্রতি জার্নাল দ্য নেচারের সায়েন্টিফিক রিপোর্টসে প্রকাশিত হয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার উত্তর কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিস্থাপন কৌশল ব্যবহার করে গত এক দশকে ডেঙ্গু রোগ ৯৬ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্রেও মশা কমানোর পরীক্ষায় ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত সফলতা দেখা গেছে।

নতুন গবেষণায় উলবাকিয়া স্ট্রেইন ব্যবহার করা হয়েছে, যা ঢাকার উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার উপযোগী। গবেষকরা প্রথমে অস্ট্রেলিয়ার কিউআইএমআরবিতে সংরক্ষিত উলবাকিয়া-যুক্ত কুইন্সল্যান্ডের এডিস ইজিপ্টি স্ট্রেইনকে ঢাকা থেকে সংগ্রহ করা বন্য মশার সঙ্গে সংকরায়ন করেন। একাধিক প্রজন্মের প্রজননের মাধ্যমে তারা ডব্লিউএএলবিবি২-ঢাকা নামে একটি ‘ভালো মশা’ স্ট্রেইন তৈরি করেছেন, যা নির্ভরযোগ্যভাবে তাদের ডিমের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মে উলবাকিয়া স্থানান্তর করতে সক্ষম।

দেখা গেছে, এই মশাগুলো সাধারণ মশার তুলনায় ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষমতা ৯২ দশমিক সাত শতাংশ কমিয়ে দিতে সক্ষম। গবেষকরা পরীক্ষাগারের খাঁচায় আবদ্ধ অবস্থায় এই মশাগুলোর বিভিন্ন দিকও পরিমাপ করেছেন; যেমন প্রজননক্ষমতা (ডিমের সংখ্যা), উর্বরতা (ডিম ফুটে বাচ্চা হওয়ার হার) এবং টিকে থাকার ক্ষমতা (২৮ দিন পর মৃত মশার অনুপাত)।

আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেছেন, ‘পরিবেশে মশা ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ থাকতে পারে, কিন্তু এগুলো জেনেটিক্যালি পরিবর্তিত নয়। এগুলো হলো ‘ভালো মশা’, যাদের দেহে রয়েছে প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া।’

‘গবেষণায় দেখা গেছে এটি ক্ষতিকর নয় বরং উপকারী। উলবাকিয়া অনেক দেশেই নিরাপদে ব্যবহার হয়েছে এবং এটি ডেঙ্গু ও অনুরূপ ভাইরাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জন্য নতুন একটি প্রতিরক্ষার পথ খুলে দিতে পারে,’ যোগ করেন তিনি।

এই গবেষণার প্রধান লেখক হাসান মোহাম্মদ আল-আমিন বলেন, ‘এই গবেষণা বাংলাদেশের জন্য মাঠপর্যায়ের পরীক্ষা পরিচালনার ভিত্তি তৈরি করেছে। যদিও পরীক্ষাগারের ফলাফল আশাব্যঞ্জক, তবে বৃহৎ পরিসরে বাস্তবায়নের জন্য সতর্ক পরিকল্পনা ও পরীক্ষা প্রয়োজন।’

ডেঙ্গু ছাড়াও, এই ‘ভালো মশা’ অন্যান্য উদ্ভবশীল ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে। উলবাকিয়া জিকা ও চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের সংক্রমণও প্রতিরোধ করতে সক্ষম বলে প্রমাণ রয়েছে।

আইসিডিডিআর,বি কিউআইএমআরবির সঙ্গে একটি চুক্তি ‘বস্তু স্থানান্তর চুক্তি’ স্বাক্ষর করেছে, যা বাংলাদেশের জন্য অ-বাণিজ্যিক প্রয়োজনে উলবাকিয়া-আক্রান্ত মশা ব্যবহারের পথ খুলে দিয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষার সম্ভাবনা এবং দেশব্যাপী প্রয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

আইসিডিডিআর,বির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, ‘এই সম্ভাবনাময় পদ্ধতির সফল প্রয়োগের আগে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করতে আমরা প্রস্তুত।’

You might also like

Comments are closed.