করোনা ভাইরাস এবং উইঘুর মুসলমান

জাতিগত দিক থেকে উইঘুর মুসলমান সম্প্রদায় তার্কিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমনঃ তুরস্ক, আজারবাইজান, তুর্কিমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান এবং আফগানিস্তানে তার্কিক জনগোষ্ঠী বসবাস করে। আর চীনে এদের বসবাস মূলত: শিঞ্জিয়ান উইঘুর অঞ্চলে।

স্বায়ত্বশাসিত এ ভূখন্ডটির আয়তন ১৬,৬৪,৮৯৭ বর্গ কিলোমিটার আর জনসংখ্যা প্রায় ২.৫০ কোটি। অঞ্চলটিতে ৪৬% উইঘুর, ৪১% হান এবং কিছু সংখ্যক অন্যান্য জনগোষ্ঠী রয়েছে। চীনে যে মুসলমান জনগোষ্ঠী বসবাস করে তার প্রায় ৮০ শতাংশই বাস করে শিঞ্জিয়ান উইঘুর অঞ্চলে। শিঞ্জিয়ানে হান জাতির জনসংখ্যা কম হলেও সমগ্র চীনে ৫৬টি জাতিগোষ্ঠির মোট যে জনসংখ্যা রয়েছে তার ৯২ ভাগই হলো হান এবং তাদের মাতৃভাষা ম্যান্ডারিনই হলো চীনের রাষ্ট্রীয় ভাষা।

হাজার বছরের ও বেশী সময় ধরে উইঘুর জাতি শিঞ্জিয়ান অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। তবে, বিংশ শতকের প্রথমার্ধে তারা স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠার পর তাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে কঠোর হস্তে দমন করার ফলে পরবর্তিতে তা স্তিমিত হয়ে যায়। তবু সহস্র বছর ধরে তারা বিনা বাধায় ধর্ম পালন করে আসছিল।

কিন্তু ৯/১১ এ যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা এবং তার পরবর্তিতে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আগ্রাসনের পর দৃশ্যপট পালটে যেতে শুরু করে। বিশেষ করে, সিরিয়াতে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গিগোষ্ঠীর সাথে উইঘুর মুসলমানদের যোগাযোগ রয়েছে এমন অভিযোগ দিয়ে চীন সরকার তাদের প্রকাশ্যে ধর্ম চর্চা যেমনঃ রোজা রাখা, মসজিদে যাওয়া, দাঁড়ি রাখা, বোরকা পরা ইত্যাদিকে অপরাধ গণ্য করে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে।

ইতোমধ্যে অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসাসহ অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে; অসংখ্য ইমাম, মোয়াজ্জেম এবং ধর্ম শিক্ষকদেরকে চাকুরীচ্যূৎ করা হয়েছে। অনেক মসজিদে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এর ছবি টানানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে এ নির্যাতনের পাশাপাশি উইঘুর সম্প্রদায়ের অধিবাসীদের মধ্যে যারা বিভিন্ন দেশে প্রবাস জীবনযাপন করছে তাদেরকে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার সমস্ত সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। উইঘুরদের মোবাইল, ইন্টারনেটসহ সকল অনলাইন কার্যক্রমের উপর সার্বক্ষণিক নজরদারী রাখা হয়। কারো বিরুদ্ধে প্রবাসীদের সাথে যোগাযোগের অভিযোগ পাওয়া গেলে সাথে সাথে বন্দি শিবিরে নিয়ে শাস্তি দেয়া হয়।

চীন সরকার ইসলাম ধর্মকে একটি মানসিক রোগ মনে করে। তাই তারা উইঘুরদের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি এবং জীবনযাপন পদ্ধতি বদলে দেয়ার জন্যে ২০১৩ সাল থেকে বিভিন্ন জায়গায় ‘রি-এডুকেশন সেন্টার’ নামে নাৎসি কায়দায় বন্দি শিবির গঠন করে তাদেরকে কারাগারে বন্দি করে আসছে। বন্দি শিবিরে উইঘুরদের মাতৃভাষার পরিবর্তে ম্যান্ডারিন ভাষা এবং কমিউনিজম শেখানো হয়। পাশাপাশি তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মদ পান এবং শুকরের মাংস খেতে বাধ্য করা হয়। এভাবে মগজ ধোলাই নিশ্চিত হলে তাদেরকে হান চীনাদের সাথে বসবাস করতে দেয়া হয়। ল

এরপরও মুসলিম সংস্কৃতির কোন অস্তিত্ব পাওয়া গেলে পুনরায় বন্দি শিবিরে নেয়া হয়। প্রতিবাদকারীদের অনেকেই ইতোমধ্যে ক্যাম্পে মৃত্যুবরণ করেছে, আবার অনেকে নিখোঁজ হয়েছে। লন্ডনের সংবাদপত্র দি ইকোমিস্টের তথ্য মতে, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে ৩৯টি বন্দি শিবিরের সন্ধান পাওয়া গেছে যেখানে কমপক্ষে বিশ লক্ষ উইঘুর মুসলমান মানবেতর জীবনযাপন করছে। বন্দিদের বেশীর ভাগই পুরুষ। পুরুষদেরকে বন্দি করার পাশাপাশি নারীদেরকে জোরপূর্বক হান জাতির পুরুষদের সাথে বিয়ে দেয়া হয়। আর শিশুদের কাছ থেকে তাদের পিতামাতার ধর্ম চর্চার বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে শিশুদেরকেও ম্যান্ডারিন ভাষা শিখতে বাধ্য করা হয়। এভাবেই চলছে নির্যাতন।

গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানের একটি স্থানীয় বাজার থেকে ভয়াবহ ছোঁয়াচে ভাইরাস করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি হয়ে তা পৃথিবীর অনেক দেশেই ছড়িয়েছে। সরকারের দমন নীতির কারণে প্রকৃত সংখ্যা জানা না গেলেও যতদূর জানা যায় এখন পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশী মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং ২৫৯ জন মৃত্যুরবরণ করেছে। একই সাথে ভাইরাসটি চীন থেকে হংকং, ম্যাকাও, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড, যুক্তরাষ্টসহ ১৬টি দেশে ছড়িয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

কিন্তু অত্যন্ত অবাক করা ব্যাপার হলো যে করোনা ভাইরাস সারা পৃথিবীতে আতংক ছড়ালেও চীন সরকার উইঘুর মুসলমানদের জন্য কোন নিরাপত্তার ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তাদের উপর চলমান ডিএনএ পরীক্ষা অব্যাহত রেখেছে। উইঘুর মুসলমানরা কোন অপরাধের সাথে জড়ালে যাতে দ্রুত সনাক্ত করা যায় সেজন্যে সরকার ২০১৫ সাল থেকে দু’টি মার্কিন কোম্পানীর সাহায্যে উইঘুরদের ডিএনএ পরীক্ষা চালিয়ে আসছে। কোন কোন ক্ষেত্রে একই ব্যক্তিকে একাধিকবারও পরীক্ষা করা হয়েছে।

এমতাবস্থায় অনেকেই আশংকা প্রকাশ করছে যে উইঘুরদের মধ্যে বিশেষ করে বন্দি শিবিরে যদি এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে তাহলে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখা দিবে।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন চীন সরকার বেল্ট এন্ড রোড নামক যে উচ্চ বিলাসী প্রকল্পের মাধ্যমে এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার ৭০টি দেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে যাচ্ছে তাকে বাঁধামুক্ত রাখতে উইঘুর অঞ্চলে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। ২০১২-২০১৭ সালের মধ্যে সমগ্র চীনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাজেট দ্বিগুন বৃদ্ধি করলেও শিঞ্জিয়ানে করা হয়েছে তিনগুন। একই সাথে মোতায়েন রাখা হয়েছে বিপুল সংখ্যক সামরিক বাহিনী।

কিন্তু চীন সরকার উইঘুরদের উপর চলমান এ সাংস্কৃতিক জেনোসাইডকে বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। একই সাথে হুমকি দিয়ে রেখেছে কেউ যদি চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায় তাহলে তার পরিণতি ভালো হবে না। এছাড়া চীনে এক দলীয় কমিউনিস্ট শাসন এবং সংবাদ মাধ্যমের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে উইঘুর সম্প্রদায়ের উপরে চলমান অমানবিক নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র সম্পর্কে তেমন জানা যায় না।

এমতাবস্থায়, বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থা উইঘুর মুসলমানদের উপর চীন সরকারের দমন নীতির কঠোর সমালোচনা করে আসছে। এ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, জাতিগত নির্মূল এবং মানবিক বিপর্যয় সম্পর্কে বিশ্ববাসীর জানা প্রয়োজন।

মাঈন উদ্দিন
সহযোগী অধ্যাপক,
নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমানে, পিএইচডি গবেষক,
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান বিভাগ, তালিন ইউনিভার্সিটি, এস্তোনিয়া।
Mujjnubd11@gmail.com

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.