অনলাইনভিত্তিক ছোট উদ্যোগ থেকে কৃষি খামার গড়ার বাস্তব গল্প, উদ্যোক্তার নিজ মুখে!

শুরুটা হয়েছিল ২০১৬ সালের প্রথম দিকে। বিষমুক্ত জৈব খাদ্যসামগ্রীর অনলাইনভিত্তিক গৃহে পৌছান ভিত্তিক ছোট উদ্যোগের মাধ্যমে। আমাদের স্লোগানটি ছিল এরকম- ‘বিষমুক্ত খাবার চাই, পড়াশোনা শেষে কাজ চাই’। সে সময়টিতে বাস্তবে ও পত্র-পত্রিকায় বিষমুক্ত খাবার ও বেকারত্ব নিয়ে ব্যাপক উৎকন্ঠা তৈরী হয়েছিল। যা এখনো বিদ্যমান। আমাদের প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘রুদ্র পসার’। গ্রামীণ শুদ্ধতা নিশ্চিত করে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিকমুক্ত প্রাকৃতিক খাদ্য সামগ্রীর পসার ঘটাতে উদ্যমী হই ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে সদ্য বেকার আমরা। খন্ডকালীন ছোটখাটো কাজ-ব্যবসার সাথে জড়িতও ছিলাম আমরা। স্বল্প পরিমান পুঁজিসংস্থান করে নেমে পড়ি। নতুন ও প্রথম হিসেবে পরিচিত গন্ডির মধ্যে ভালো সাড়া পাচ্ছিলাম। বিষমুক্ত খাবারের প্রাপ্যতা নিয়ে আমরা সামাজিক আন্দোলনের স্বপ্ন দেখি।

বছরখানেক ধরে আমরা গ্রামীণ সমাজ থেকে খাদ্যসামগ্রী যেমন: মধু, ঘি, সরিষার তেল, মুড়ি, খই, আখের গুড়, খেজুর গুড়, নারিকেল তেল, বিভিন্ন ধরনের ডাল, ফল প্রভৃতি সংগ্রহ করে কোন রকম পরিবর্তন ছাড়াই বিক্রেতার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিই। এটি সীমাবদ্ধ ছিল ঢাকার মধ্যেই। অংশীদারিত্বের জটিলতা-সংকট এবং পুঁজির অভাবে ব্যবসাটি গুঁটিয়ে নিতে হয়। যদিও আমার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় পরিচিত কিছু গ্রাহকের কাছে এখনও পছন্দমতো পণ্য সরবরাহ বিদ্যমান।

এখানেই শেষ নয়। পারিবারিকভাবে আমাদের বিশাল মৌসুমি আমের বাগান রয়েছে। যা বানিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হয়। বাণিজ্যিকভাবে হলেও সার-কীটনাশক গতানুগতিক হারের থেকে কম ব্যবহার করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায়ই স্বপ্ন ছিল, আম থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রীর একটি কারখানা স্থাপন করা। যা আসলে অনেক ব্যয়বহুল। বছরখানেক (২০১৭ সাল) ধরে খাদ্য বিষয়ক শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিবর্গ ও সহায়ক সরকারি প্রতিষ্ঠানে ঘোরাঘুরি করি। বেশকিছু অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ ও ধারণা নিয়ে পরিবারে পুঁজিসংস্থানের প্রস্তাব দিলে তা তিরষ্কারের সাথে বর্জিত হয়। যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি চাকরির চেষ্টা করতে পরামর্শ দেয়। বিভিন্নভাবে বোঝালেও পরিবার চাকুরি সন্ধানের ও নিযুক্ত হওয়ার ব্যাপারে অনড় থাকে। আমিও মাধ্যমিকের সময় থেকেই অনড় ছিলাম, যা কিছু হয়ে যাক জীবনে কোনদিন চাকরি করবো না। চাকরির প্রতি ঘৃণা নয়, একটু স্বাধীনভাবে জীবন-যাপন ও মানুষকে নিয়ে নতুন কিছু করা, ব্যবসা এবং সেবা একইসাথে পরিচালনা করা, এসব ছিল মাথায়।

২০১৮ সালের শেষের দিকে, ঢাকা ছেড়ে চূড়ান্তভাবে বাড়িতে চলে আসি। বাড়িতে গিয়ে কিছু একটা করতে হবে এই প্রেষণায়। বাড়িতে এসে বাল্যবন্ধুর সাথে অংশীদার হিসেবে পানি ব্যবস্থাপনা প্লান্ট ব্যবসার সাথে যুক্ত হই ও কিছু পুঁজি বিনিয়োগ করি। এটি মূলত খাবার ও ব্যাটারিতে ব্যবহারযোগ্য পানি। পাশাপাশি গৃহস্থলি ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত বিদ্যুতচালিত পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্রের ব্যবসায় যুক্ত হই। যা এখনও বিদ্যমান।

নিজস্ব বড় উদ্যোগের কথা সবসময়ই ভাবতে থাকি। ইন্টারনেট তথা বিভিন্ন মানুষের পরামর্শে অনেক ধরনের ব্যবসার উদ্যোগের ধারণা থাকলেও পুঁজিসংস্থানের বাঁধাটিই বারবার সামনে আসে। নিজস্ব কৃষি জমি থাকায় কৃষি খামারের উদ্যোগটি মাথায় ছিল। কৃষি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও পেশাদার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আর এক বাল্যবন্ধুর সাথে আলোচনা ও পরামর্শের মাধ্যমে তাকে অংশীদার করে নিয়ে সমন্বিত ও মিশ্র ফল-সবজির কৃষি খামার করতে উদ্যমী হই। ল

হাতে অল্প কিছু পুঁজি থাকায় দ্রুত কাজ শুরু হয়ে যায়। ১০ বিঘা জমি নিয়ে শুরু করি। আমাদের স্থানীয় মাটিতে আমরা ক্যাপসিকাম উৎপাদনের উদ্যোগ নিই। পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালাই। বীজ প্রাপ্তি ও বপন দেরিতে হওয়ায়, আবহাওয়া ও তাপমাত্রা প্রতিকূল থাকায় তাতে পরিপূর্ণ সফলতা আসেনি। মূলত আমরা আমবাগানের মধ্যে বারমাসী ও উচ্চফলনশীল পেয়ারা উৎপাদনে উদ্যমী হই। পেয়ারা গাছের চারা তৈরির মধ্যবর্তী সময়ে আমরা ক্যাপসিকাম চাষ করতে চেয়েছিলাম।

যা হোক, আমরা মে মাস থেকে প্রথমে ৬ বিঘা জমিতে পেয়ারা গাছের চারা লাগানো শুরু করি। যা থেকে ৮/৯ মাসের মধ্যেই অর্থাৎ মার্চ-এপ্রিলে ফল বাজারজাত করা হবে। আমরা বারমাসী সজিনা উৎপাদনে আগ্রহী হই। সজিনা বীজ সংগ্রহ করে আমরা প্রায় ৩ বিঘা জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে সজিনা গাছ বপন করি। অল্প সংখ্যক সজিনা গাছে ৪ মাসের মধ্যে মুকুল দেখা দেয়। বর্তমানে সব গাছেই মুকুল রয়েছে। আশা করছি, আগামী তিন মাসের মধ্যে তা বাজারজাত করা যাবে।

আমাদের এই সমন্বিত মিশ্র কৃষি খামারের তিন আইলের অংশে পাকা কলা উৎপাদনের লক্ষ্যে কলা গাছ লাগাই। আরেকটি আইলের অংশে উচ্চফলনশীল লটকনের গাছ লাগাই। বনজ গাছের ছায়া থাকায় আইলের সাথের জমির এই অংশটির সর্বোত্তম ব্যবহারের সুবিধার্থে লটকন গাছগুলো লাগাই।

আমাদের এই কৃষি খামারের সর্বশেষ আইলের অংশে বিষমুক্ত সতেজ সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যে মাঁচা তৈরি করে গুল্মজাতীয় সবজি গাছের বীজ বপণ করি। এর মধ্যে রয়েছে – শিম, বরবটি, পটল, পুইশাক, করলা, চিচিঙ্গা, পটল, ঝিঙে, শশা, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, কাকরোল। এ সকল গাছেও দুই মাসের মধ্যে সবজির মুকুল ও সবজি ধরা শুরু করেছে। খামারের যে তিন অংশে কলা গাছ লাগানো তার মধ্যবর্তী দূরত্বে আমরা বীজবিহীন কাগজী লেবুর গাছ বপণ করি, যাতে লেবু উৎপাদনের সাথে সাথে জমির আইলের সাথের সীমানাপ্রাচীর সুরক্ষিত থাকে।

এই খামারটিতে পূর্ব থেকেই ২ বছর বয়সী হিমসাগর ও হাড়িভাঙ্গা আমের গাছ ছিল। সম্প্রতি ২ টি লিচু গাছও লাগানো হয়েছে, যা তিন বছর পর ফলনশীল হবে। উল্লেখ্য, আমাদের খামারে কিছুসংখ্যক দেশি খেজুরের গাছ আছে, যা থেকে মৌসুুমে রস, গুড় ও খেজুর উৎপাদিত হয়।

সম্প্রতি আমরা আরো ৬ বিঘা জমিতে দার্জিলিং কমলা ও বারমাসি পেয়ারার বাণিজ্যিক খামারের কার্যক্রম চালাচ্ছি। অদূর ভবিষ্যতে আমরা ইচ্ছা পোষণ করছি, গ্রীণ হাউস উৎপাদন, সজিনা পাতার চা উৎপাদনসহ রামবুটান, ম্যাংগোস্টিন, আপেল, আঙুর, মিশরীয় ডুমুর (ত্বিন ফল), পারসিমন, বারোমাসি বাতাবী লেবু, এভোক্যাডো ফলের বাণিজ্যিক উৎপাদন ও খামার স্থাপন করার। কৃষিভিত্তিক পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি কৃষিভিত্তিক পণ্যের শিল্পোৎপাদন তথা কৃষি কারখানা স্থাপনের স্বপ্ন পূরণ হোক এই কামনায় শেষ করছি।

এম. আর. তৌফিক হাসান,
স্বত্বাধিকারী,
আর. পি. এগ্রো ফার্ম এন্ড ফুডস্
(সমন্বিত ও মিশ্র কৃষি খামার প্রকল্প)

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.