বদ্ধ বাতাসে ঝুঁকি বাড়ে করোনার, সর্বত্র স্বাভাবিক বায়ুপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে

করোনাভাইরাস সংক্রমন পরিস্থিতি প্রতিরোধে হাত ধোয়া, মাস্ক পড়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছাড়াও বাসাবাড়িতে মুক্তবাতাসের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শপিংমলসহ সর্বত্র দরজা-জানালা খুলে বাতাস চলাচলের স্বাভাবিক ব্যবস্থা রাখতে হবে। যে কোনো নতুন পদক্ষেপ গ্রহণের আগে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে, প্রস্তুত হতে সময় দিতে হবে। সকলের জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া প্রতিবেশী ভারতে উচ্চ সংক্রমন পরিস্থিতির কারণে সরকারকে গ্রহণ করতে হবে সতর্ক পদক্ষেপ।

রবিবার রাতে (২৫ এপ্রিল) “স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম” এর উদ্যোগে ‘করোনাভাইরাসের বিস্তার ও প্রতিরোধ নিয়ে বিভ্রান্তি এবং আশু করণীয়’ শীর্ষক ওয়েবিনারে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এসব মতামত দেন।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম এর প্রতিষ্ঠাতা ড. জিয়াউদ্দিন হায়দারের পরিচালনায় এতে আলোচনায় অংশ নেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ পাবলিক হেলথ এর অধ্যাপক ড. মলয় কান্তি মৃধা এবং যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস এর ক্লিনিকাল প্রাক্টিশনার, লিস্টার হসপিটাল এর জিপি রেজিস্ট্রার ডা. সালমা হাসান।

আলোচনার শুরুতে ড. মলয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, নভেল করোনাভাইরাস বা সার্স-কোভ-২ মূলত বাতাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হয় বলে সম্প্রতি একদল গবেষকের একটি প্রবন্ধ মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দশটি কারণ তুলে ধরা হয়েছে যেগুলো অনুমান নির্ভর। এগুলোকে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করতে হবে।

তিনি বলেন, গবেষকরা হাইপোথিসিসের পক্ষে কিছু প্রমান তুলে ধরেছেন মাত্র। দ্বিতীয়ত, উনারা এ কথাও বলেননি যে অন্যান্য মাধ্যমগুলো থেকে করোনা ছড়ায় না। তারা যুক্তি দিয়ে প্রমান করতে চেয়েছেন যে বাতাসের মাধ্যমে ছড়ানোটাই প্রধান উপায় হতে পারে।

সংস্পর্শ, ড্রপলেট ছাড়াও বাতাসের মাধ্যমেও করোনা ছড়ায় প্রসঙ্গে ডা. সালমা বলেন, এখন আমাদের আরো সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে। আগের মতোই সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে; সার্জিক্যাল মাস্ক পড়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

করোনা পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যে গত বছর করোনা সংক্রমন পরিস্থিতিতে বাসা থেকে বের হতে, মুক্ত বাতাসে গিয়ে নিঃশ্বাস নিতে, দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলতে বলা হয়েছিল। যুক্তরাজ্যে দ্বিতীয় প্রবাহ শেষ হয়েছে। এরপরও কোন কনসার্ট হয়নি, সিনেমা হল চালু হয়নি, জনসমাগম ঘটে এমন কোনো স্থান খুলে দেয়া হয়নি। বাসা থেকেই মানুষ কাজ করছে। করোনা সংক্রমন প্রতিরোধে সব ধরনের বিধিনিষেধ এখনো বজায় রয়েছে। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, স্বাস্থ্য বিধি মেনে অবশ্যই বাসার বাইরে যাবেন, বাসার দরজা-জানালা খুলবেন। কেননা ঘরের বদ্ধ জায়গায় যদি ভাইরাসের ঝুঁকি থাকে দরজা জানালা খুলে দেয়ার ফলে বাতাসের সাথে তা বেরিয়ে যেতে পারে। এর মানে নতুন করে আরো সচেতন হতে হবে।

জাপানের প্রসঙ্গ টেনে ড. মলয় বলেন, জাপানে থ্রি সি মেনে চলতে বলছে। অর্থাৎ ক্রাউড, ক্লোজ কন্টাক্ট ও ক্লোজ কনভার্সেশন-এই তিনটি বিষয় এড়িয়ে চলতে বলা হচ্ছে। এগুলোর সাথে হাত ধোয়া থেকে শুরু করে আগে যেসব স্বাস্থ্য বিধি আমরা অনুসরণ করতাম সেসবও করবো। আমাদের দেখতে হবে একটি বদ্ধ ঘরে ভাইরাসের ঘনত্ব কতটুকু, আর একজন মানুষ কতটুকু সময় একটা বদ্ধ জায়গায় কাটালে করোনা আক্রান্তের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কিভাবে আমরা বাতাসে ভাইরাসের ঘনত্ব কমাতে পারি? একটি উপায় হচ্ছে বদ্ধ ঘরে বাতাসের চলাচল বাড়িয়ে দিতে হবে। বাংলাদেশের জন্য ভালো উপায় হলো বদ্ধ ঘরের দরজা-জানালা খুলে দেয়া। শপিংমল যদি খুলতেই হয় সেক্ষেত্রে বদ্ধ জায়গায় মানুষের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ, তাদের কাটানো সময় নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। সবার জন্য মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। আমি সবাইকে অনুরোধ করবো একটি সার্জিক্যাল মাস্ক, তার উপর আরেকটি কাপড়ের তৈরি মাস্ক পরতে। এতে নিজে অন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়া অথবা নিজের দ্বারা অন্যদের সংক্রমিত করবার সম্ভাবনা কমে যাবে।

ডা. সালমা বলেন, করোনা সংক্রমন পরিস্থিতিতে যাচ্ছে বাংলাদেশে হেল্থ জার্নালিজম ঠিক মতো হচ্ছে না। ‘মিস কমিউনিকেশন’ এর কারণে মানুষের মাঝে ভুল তথ্য চলে যাচ্ছে, গুজব ছড়িয়ে পড়ছে, যেগুলো খুব সহজেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে। সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য দিতে চাইলে হেল্থ এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড থাকা উচিত। কঠিন বিষয় এবং সঠিক তথ্য সহজভাবে মানুষের কাছে তুলে ধরা আমাদের দায়িত্ব। যুক্তরাজ্যে যারা স্বাস্থ্য বিষয়ে সাংবাদিকতা করছেন তাদের সবাই হেল্থ ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা।

ড. মলয় বলেন, বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু প্রশংসনীয় কাজ করছে। তারপরও বলবো, আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আরো উন্নয়ন ঘটাতে হবে। ভারতে অক্সিজেনের অভাবে তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অতিরিক্ত চাপ পড়েছে। সেখানে মানুষ মারা যাচ্ছে। এই অবস্থা বাংলাদেশে হোক তা আমরা চাই না। ভ্যাকসিনের ব্যাপারে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা আরো জোরদার করতে হবে। সবার কাছেই যেনো ভ্যাকসিন পৌঁছে দেওয়া যায়।

ডা. সালমা বলেন, করোনা সংক্রমন রোধে যখন যে পদক্ষেপ নেয়া হয় তার জন্য মানুষকে প্রস্তুত করতে হবে, সচেতন করতে হবে। কি কারণে কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে তা সরকারিভাবে সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে।

তিনি বলেন, ভারতের কয়েকটি ভ্যারিয়েন্ট যুক্তরাজ্যেও ধরা পড়েছে। সে কারণে এখন ভারত থেকে যারাই আসবেন তাদেরকে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে রাখতে হবে, টেস্ট করাতে হবে। ভারত প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য এটা ক্রিটিক্যাল সময়। এই অবস্থায় বাংলাদেশকে সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.