‘প্রতিটি রেস্টুরেন্টে লেখা থাকুক- জিরো ওয়েস্ট ফর ফুড’

খাবার অপচয়ের কথা আসলেই আমার নানীর একটা কথা মনে আসে যেটা আমাকে বেশ প্রভাবিত করেছিল। আমার বাসায় খাবারের অপচয় হতো। আমার নানীকে দেখতাম বাসী খাবার হলেও সে খাবে কখনো ফেলে দিতোনা। আমরা ভাইবোনরা মজা করে নানীকে কৃপণও বলতাম।

একদিন আমার নানী বললেন, তোমরা মনে করো, এটা কার্পণ্য! না খাবার অপচয় অনেক বড় গুণাহ। কতো মানুষ খেতে পায়না!

তারপর তিনি ছোট একটি ঘটনা বললেন, “আমার পাশের বাড়িতে এক মহিলা ছিলেন যিনি ৩/৪ সন্তানের জননী। তিনি আমার কাছে প্রতিদিন ভাতের মাড় নিতে আসতেন। তাদের এতোই অভাব ছিল যে সেই মহিলা তার সন্তানদের রান্না করে খাওয়াতে পারতেন না।
তবে তার মাঝে লজ্জাবোধ ছিল। কারো বাসায় যে প্রতিদিন খাবার চাওয়া যায়না তা তিনি বুঝতেন এবং শুধু ভাতের মাড়ই চাইতেন, অন্য কিছু না। আমি মাড়ের মধ্যে ইচ্ছা করে বেশি ভাত ফেলে দিতাম। প্রথমদিকে মহিলাটি ভাবতেন মাড় গালার সময় হয়তো পড়ে যায়। একদিন তিনি বোঝে ফেলেন যে আমি ইচ্ছে করেই দিয়ে দিই ভাত। তুমি বিশ্বাস করবে না, মহিলাটি এটা বোঝার পর আমার পায়ের কাছে এসে অনেক কেঁদেছিলেন আর অনেক দোয়া করেছিলেন। তার কাছে সেই ভাতের মাড় হয়তো কাচ্চি বিরিয়ানির চেয়েও সুখাদ্য।

ভাবতেই অবাক লাগে শুধুমাত্র একটু মাড়ে একজন মানুষের কতো সন্তুষ্টি, কারো জীবন বাঁচে এভাবেই! আর আমাদের টেবিল ভরা খাবারেও হয় না!

দাওয়াত মানেই কমপক্ষে ১৫ পদের নিচে দেয়াই যাবেনা,আইটেম কম হলে ভাবা হয় হোস্ট কৃপণ বা আন্তরিক নয় অথবা গেস্টের অবমূল্যায়ন। ব্যাপারটা কি আসলেই তাই! খাদ্যের অভাবে যেই পৃথিবীতে মানুষ মারা যাচ্ছে!

নিশ্চয়ই ভুলে যাননি কেভিন কার্টের পুলজিৎকার পাওয়া বিখ্যাত ছবিটি,যেখানে দক্ষিণ সুদানের একটি শিশু না খেয়ে শুকিয়ে মৃতপ্রায় আর তার পাশেই শকুন অপেক্ষা করছে শিশুটির মৃত্যু নিশ্চিত হতে।

এটাই মনে হয় আলোকচিত্রের নিষ্ঠুরতম দৃশ্য। সারা পৃথিবীতে তখন আলোড়ন শুরু হলেও পরবর্তীতে বেমালুল তা ভুলে যাওয়া হয়। যদি মনেই রাখা হতো তাহলে ২০১৮ তে ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুযায়ী এখনো প্রতিবছর ৩.১ মিলিয়ন শিশু খাবারের জন্য মারা যেতো না।

আমি নানীর কাছ থেকে শোনা সেই ঘটনার পর কখনো খাবার অপচয় করে ফেলে দিয়েছি বলে মনে পড়েনা। কোথাও খাবার অর্ডার দিলে বাড়তি খাবার নিয়ে আসি, এমনকি যদি শুধু ভাতও হয় তাও ভালো ভাত ফেলে রাখি না।

একদিন আমার এক পরিচিত মানুষ বলেছিল দেখতে ছোটলোকি লাগে এটা, আনতে হবেনা, পাশের দম্পতি হাসবে।

আমি জানি এটা করতে হলে কিপ্টা, ছোটলোক,ফকির বহুত বাজে কথাই আপনারা শুনবেন, আমিও শুনেছি কয়েকবার। আবার চেটেপুটে খেলে খাদক উপাধিও পেতে পারেন। কিন্তু যে যাই বলুক না কেনো নিজ ইচ্ছায় অপচয় বন্ধ করুন। খাবার নিবেন প্রয়োজন মতো আর যদি বেশি নিয়েই ফেলেন, এক্সট্রা খাবার পার্সেল করবেন, আপনার খেতে ইচ্ছা না হলে যদি খাবার ভালো থাকে, হাত দিয়ে নষ্ট না করে অসহায় কাউকে দিয়ে দিবেন।

আমরা প্রত্যাশা করি, রেস্টুরেন্টে লেখা থাকবে “নো ভ্যাট অন ফুড”।
তার সাথে প্রতিটি রেস্টুরেন্টে এটাও লেখা থাকুক “জিরো ওয়েস্ট ফর ফুড” এবং ভোজনরসিকরাও বলুক “ইয়েস, উই এগ্রি এন্ড ডো সো”।.

পোপ ফ্রান্সিস বলেছিলেন- “খাবার অপচয় করা গরীবের কাছ থেকে চুরি করার মতো। অপচয় করার আগে, চুরি করার আগে দয়া করে দ্বিতীয়বার ভাবুন”।

দয়া করে অপচয়ের আগে, গরীবেরর নিকট চুরির আগে আরেকবার ভাবুন। ৫টি মৌলিক অধিকার থেকে যেন কেউ বঞ্চিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখুন।

নাজমুন নাহার চৈতী
প্রভাষক
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.