রোহিঙ্গাদের ফেরাতে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য চাইল বাংলাদেশ

রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে যাতে অবিলম্বে ফেরত যেতে পারে, সে জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরালো ভূমিকা ও সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দিতে যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে দেখে।

ঢাকা সফররত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ডেপুটি সেক্রেটারি স্টিফেন এডওয়ার্ড বিগান বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এর আগে সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বিগানের বৈঠক হয়।
বিগানের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন চাই; যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বসম্প্রদায়ের উচিত মিয়ানমারে তাদের প্রত্যাবাসনে সহায়তা করা।’ জবাবে বিগান বলেন, ‘আমরা দীর্ঘায়িত রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান চাই। আমরা এই ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রতি আমাদের সমর্থন অব্যাহত রাখব।’

বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব ইহসানুল করিম। তিনি বলেন, “বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়েছে। এটি আমাদের জন্য অতিরিক্ত বোঝা। সমস্যাটি মিয়ানমার তৈরি করেছে এবং আমরা তাদের সাথে সংলাপ করছি, তাদের উচিত তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়া।’”

শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু একটি সামাজিক সমস্যা এবং মিয়ানমারের বিপুলসংখ্যক বাস্তুচ্যুত নাগরিক কক্সবাজারে আশ্রয়শিবিরগুলোতে বাস করছে। তিনি বলেন, ‘কিছু মহল অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত হতে তাদের ভুল পথে চালিত করতে পারে। সুতরাং আমরা অবিলম্বে তাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন করাতে চাই।’

প্রধানমন্ত্রী ও মার্কিন ডেপুটি সেক্রেটারি আত্মগোপনে থাকা সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি নিয়েও আলোচনা করেন। এ বিষয়ে বিগান জানান, মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস বিষয়টি পর্যালোচনা করছে। তিনি আরো বলেন, কভিড-১৯ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসাসেবা আবার চালু করা হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ডেপুটি সেক্রেটারি স্টিফেন এডওয়ার্ড বিগান বলেন, তিনি এরই মধ্যে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘মার্কিন সরকার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নে বাংলাদেশের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করবে।’

বিগান বলেন, ‘আমরা করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন সহজলভ্য করার কাছাকাছি এসে গেছি এবং আশা করি, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে বাজারে এই ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে।’ তিনি বলেন, বেশ কয়েকটি মার্কিন কম্পানি ভ্যাকসিন তৈরি করছে এবং আগামী বছর থেকে ব্যাপক হারে টিকাদান শুরু হবে।

মার্কিন এই শীর্ষ কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভাবনীয় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করেন। বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি খাতে বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা আরো জোরদার করতে চায়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশ-বিদেশ থেকে আরো বেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে তাঁর সরকার দেশজুড়ে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করছে। তিনি মহামারির মধ্যে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার পাশাপাশি কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে তাঁর সরকারের পদক্ষেপগুলোও সংক্ষেপে তুলে ধরেন। এ সময় ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলার ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোকে জোরালো ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ডেপুটি সেক্রেটারি স্টিফেন এডওয়ার্ড বিগান। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিকভাবে সব দেশের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করতে চাই আমি। এটি শুধু বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব নয়, বৈশ্বিক অগ্রাধিকার। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সব দেশের উচিত রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমার যাতে উদ্যোগী হয়, সে জন্য সমানভাবে স্পষ্টভাষী হওয়া।’

কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ এবং জাতিসংঘ। রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বে একটি ‘দীর্ঘমেয়াদি’ জয়েন্ট রেসপন্স প্রগ্রাম আলোচনায় থাকলেও বাংলাদেশ চায় রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরানোর বিষয়ে জোর দিতে। ২২ অক্টোবর জয়েন্ট রেসপন্স প্রগ্রামের আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।

এ বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বিগান বলেন, ‘আমরা এটিকে রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হিসেবে দেখি না। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আমরা একমত যে রোহিঙ্গাদের অধিকার পুনরুদ্ধার এবং ক্যাম্প থেকে তাদের ফিরে যাওয়ার ওপর ভিত্তি করে সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। রোহিঙ্গাদের তাত্ক্ষণিক মানবিক প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি সংকটের দীর্ঘস্থায়ী সমাধানে পৌঁছানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগ দ্বিগুণ করতে হবে।’

রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা প্রসঙ্গে বিগান বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকটে যুক্তরাষ্ট্র সব সময় স্পষ্টভাষী ছিল এবং মিয়ানমারের ভেতরে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বন্ধে এবং তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক প্রভাবও ব্যবহার করেছে।’

বৈঠকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সমস্যা নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা জানিয়ে বিগান বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে শুধু তাদের জরুরি প্রয়োজন মেটানো নয়, পাশাপাশি বাংলাদেশের কাঁধ থেকে এ বোঝা নামানোর জন্য, স্থায়ী সমাধানের জন্য বিরাজমান ইস্যুগুলোকে সমন্বয় করতে আমরা কিভাবে একসঙ্গে কাজ করতে পারি, তা আলোচনায় ছিল।’

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে দেখে বলে জানান বিগান। এ ছাড়া অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল গড়তে সেই অংশীদারি যুক্তরাষ্ট্র আরো বাড়াতে চায় বলেও জানান তিনি। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কাজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কেন্দ্রভূমি হবে বলেও জানান বিগান।

বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, ‘আমরা আলোচনা করেছি, এটি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল দেখে থাকেন। তাঁরা এ বিষয়টি রিভিউ করছেন বলে জানিয়েছেন।’

যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামিতে বাংলাদেশ কনস্যুলেট করার বিষয়ে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে জানিয়ে বিগান বলেন, ‘আমেরিকার জনগণ ও বাংলাদেশি আমেরিকানদের কল্যাণে বাংলাদেশের কূটনৈতিক উপস্থিতি বাড়াতে চাই আমরা।’

তিন দিনের সফরে গত বুধবার বিকেলে ঢাকায় পৌঁছেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তা বিগান। ওই রাতেই ঢাকার একটি হোটেলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়। সেখানে মহামারি-পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের অংশ হিসেবে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) সম্ভাবনা নিয়ে কথা হয় বলে জানা গেছে।

এর আগে গতকাল সকালে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেছেন বিগান। সেখানে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানান তিনি। এ সময় ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটরস বুকের লেখা বক্তব্যে অতীতের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আশা প্রকাশ করেন তিনি।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.