নদীর পথে কোলা ব্যাঙ

মনিরা মিতা

বর্ষার দিনে গ্রামের আলপথে এক হাঁটু কাদা। সে পথে হাঁটছে রতন। কাদায় কাদায় মাখামাখি রাস্তা আর ধানক্ষেত পেরিয়ে রতন এসে পৌঁছালো খালপাড়ে। এই জায়গাটা ওর খুব প্রিয়। প্রতিদিন অনন্ত একবার এখানে আসা ওর চাই-ই-চাই। কারন খালের পানিতে ওর এক বন্ধু থাকে যে। না না কোন কুমির নয়। একটা কোল ব্যাঙ। রতনের বন্ধু সে। রতন ওর নাম দিয়েছে “পুটু”। পুটুর সাথে রতনের বেজায় ভাব। মন খারাপ অথবা মনভালো সে যাই থাকুক এই ঘাটে এসে বসে রতন। তার সমস্ত উদাসীনতা যেন কোনো জাদুকাঠির বলে উধাও হয়ে যায়। পুটু ওর সাথে কথা বলতে পারে। ওর কথা বুঝতেও পারে।

এইতো সেদিন রতন মন খারাপ করে খালপাড়ে এসে বসতেই পুটু এসে হাজির। অভিমানে গাল ফুলিয়ে বললো এই তোমার আসার সময় হলো বুঝি। আমি সারাটাদিন তোমার অপেক্ষায় আছি। রতন বললো আমার মন খারাপ। এ কথা শুনে পুটু ব্যাঙ ঘ্যাঙ করে হেসে বললো, রতন সোনার বিয়ে নাকি?

পুটু ছড়া কাটে —

“কোলা ব্যাঙটি নাচ জুড়েছে

বাঁশি কাশি নিয়ে

ঘোড়ায় যাবে রতন সোনা

আজ যে তাহার বিয়ে।”

ওমনি রতনের গালটা লজ্ল হয়ে উঠলো। রতন মুখ নিচু করে বললো “যা আমি তো ছোট। মাত্র দশ বছর বয়স। এতোটুকু মানুষের বিয়ে হয় বুঝি?”

রতন আর পুটু অনেক গল্প করে। ঝাঁকড়া চুল হারিয়ে শীতে গাছগুলো ন্যাড়া হলে কেমন লাগে। পাখির ছানাগুলো ডিম ফুঁটে বের হলে কেমন তুলতুলে থাকে। বাছুর কি করে মায়ের পিছু পিছু তিড়িং বিড়িং করে নাচে। হাঁসগুলো কি করে হেলেদুলে হাঁটে। বেজি কি করে মুরগী চুরি করে। এমন সব রাজ্যের গল্প করে দু’জন মিলে।

আজ দু’দিন পুটুর মনটা খুব খারাপ। রতনটা নানা বাড়ি বেড়াতে গেছে। গেল বছর রতনের বাবা-মা গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেছে। রতন তারপর থেকে ফুফুর কাছে থাকে। ফুফু তাকে ভালোবাসে। তবে বাড়ির অন্য কেউ ওকে ভালোবাসে না। ছোট রতনের মনটা কষ্টে ভরে থাকে।

১৫ দিন স্কুল বন্ধ। গরমের বন্ধ। এই সুযোগে ফুফু ওকে নানা বাড়ি রেখে এসেছে।

একসপ্তাহ পরে রতন ফিরেছে। এসেই ছুটে এসেছে পুটুর কাছে। রতন ওকে ডাকলো। পুটু গাল লাল করে ঘাপটি মেরে রইলো। কোন কথা বললো না। রতন অনেক কষ্টে ওর অভিমান ভাঙ্গলো।

হঠাৎ রতন বললো আচ্ছা পুটু তুমি কি সারাজীবন এই খালেই জীবন কাটিয়ে দেবে? নদীতে সাঁতার কাটত ইচ্ছে করে না তোমার?

রতন এবার নানাবাড়ি থেকে পাশের গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিল ওর মামার সাথে। সেখানে গিয়ে রতন নদী দেখেছে “মধুমতি” নদী। কত বড় সে নদী! এপার থেকে ওপার দেখা যায় না। নদী দেখে খুব ভালো লাগে রতনের।

নদী সেটা আবার কি? পুটু অবাক হয়ে বলে। রতন ওকে নদীর গল্প শোনায়। নদীতে অনেক পানি। নদীতে কুলকুল করে বয়ে যায় স্রোত। মাঝিরা নৌকা নিয়ে দূর দূরান্তে ছুটে চলে। কত মাছ নদীতে! অনেক জলজ প্রানী ওখানে থাকে। ওখানের ব্যাঙগুলো সারাদিন চিংড়ি, ছোটমাছ, পোকা ধরে খায়। কত মজা নদীতে!

রতনের গল্প শুনতে শুনতে পুটুর ইচ্ছা করে নদীতে যেতে। পুটু বলে আহারে যদি নদীতে আমি যেতে পারতাম।

বাড়ি ফিরে রতনের খুব পুটুর কথা মনে পড়ে। রতন সিদ্ধান্ত নেয় যে করেই হোক পুটুকে নদীতে পৌঁছাতেই হবে।

পরদিন রতন সকাল সকাল পুটুর কাছে যায়। রতন বড় একটা সাদা পলিব্যাগ এনেছে সাথে করে। পুটু বলে কি হবে এই পলিব্যাগ দিয়ে?

রতন ওকে বলে আমি পলিব্যাগ ভর্তি করে পানি নেব। তারপর তোমাকে ঐ পানির ভেতর ছেড়ে দেব। তাহলে তোমার ওখানে থাকতে কোন সমস্যা হবে না। তাপর পলিব্যাগের মুখ আটকে আমি তোমাকে নদীর কাছে নিয়ে যাব।

রতনের কথা শুনে পুটুর আনন্দ আর ধরে না। ঘ্যাঙ ঘ্যাঙ করে ডেকে ডেকে সে তার আনন্দ প্রকাশ করে।

যেই কথা সেই কাজ। রতন পলিব্যাগে পানি ভর্তি করে। তার ভেতর পুটুকে নেয় এবং রতন ছুটে চলে মধুমতি নদীর দিকে।

অনেকটা পথ পায়ে হেঁটে বেশ ক্লান্ত রতন। একটা গাছের নিচে পুটুকে রেখে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল সে। এমন সময় দুইটা ১৩/১৪ বছরের ছেলে ঐ গাছের নিচ দিয়ে যাচ্ছিল। পলিব্যাগের ভেতর পানি দেখে কৌতুহলে থামলো ওরা। ছোঁ মেরে নিয়ে গেল পলিব্যাগটা। রতন খুব অনুরোধ  করলো ওদের পলিব্যাগটা দিয়ে দিতে। কিন্তু ওরা অট্টহাসি দিয়ে বললো এটা তোকে দেব না। আজ এই ব্যাঙ ভাঁজি করে খাব আমরা। ওদের কথা শুনে পুটুর বুক কাঁপতে থাকলো। পুটু কাঁদ কাঁদ হয়ে রতনকে বললো “আমাকে বাঁচাও বন্ধু।” পুটুকে বাঁচাতে হঠাৎ রতনের মাথায় বুদ্ধি এলো। আচমকা এক ধাক্কা মেরে ওদর ফেলে দিয়ে পলিব্যাগ নিয়ে ভোঁ দৌঁড় দিল রতন। অনেকটা পথ দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হাফিয়ে গেল রতন। এখন পুটু আর রতন নিরাপদ। পুটুর বুকে যেন প্রাণ ফিরে এলো।

ঐ তো সামনের বাঁক পেরুলেই নদী। পুটুর মন আনন্দে আটখানা। সে আল্লাদ করে ঘ্যাঙ ঘ্যাঙ ডাকছে। পুটুর খুশিতে রতনও খুশি। কিন্তু সে খুশি বেশিক্ষণ রইলো না ওদের। কোথা থেকে এক কুকুর ছুটে এলো। তাড়া করলো রতনকে। রতন প্রাণ ভয়ে দৌঁড়াতে শুরু করলো। বাবা বলেছিল কুকুরে কামড়ালে নাভীতে অনেক ইনজেনশন দিতে হয়। সে মনে হতেই রতনের হাত- পা ঠান্ডা হয়ে এলো। সে প্রাণ পণে ছুটতে লাগলো। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ একটা গাছের শেকড়ে বেঁধে পড়ে গেল রতন। হাত থেকে ছিটকে পড়লো পলিব্যাগ। পলিব্যাগ ফেটে সব পানি পড়ে গেল। মাটিতে আছড়ে পড়লো পুটু। ওদিকে কুকরটাও পিছু ছাড়ে নি। রতন বুঝলো পালাতে হবে। নইলে তার আর পুটু দু’জনেরই বিপদ হবে। পুটুকে হাতের তালুতে বন্ধ করে রতন দিল এক ছুট।

হাতের তালুতে প্রায় দম বন্ধ হবার অবস্থা পুটুর। রতনের সাথে দৌড়ে না পেরে অবশেষে কুকুর ওদের পিছু ছেড়েছে।

ওদিকে রতন পুটুকে নিয়ে নদীর পাড়ে চলে এসেছে। রতন বলে এই তো তোমার নদী বন্ধু।রতন হাত থেকে পুটুকে নিচে নামিয়ে দেয়। পুটু মুগ্ধ চোখে বিশাল নদী দেখে। ওর চোখে- মুখে কৃতজ্ঞতা। রতন বলে আজ থেকে এই নদীই তোমার বাড়ি। সে আরও বলে -আমি মাঝে মাঝে এসে তোমার সাথে দেখা করে যাব। তোমার নাম ধরে ডাকলেই চলে এসো।

পুটুর চোখে পানি চলে আসে। তবে এ অশ্রু কাষ্টের না, আনন্দের। প্রকৃত বন্ধু পাবার আনন্দের।

পুটু রতনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ছোট ছোট লাফ দিয়ে নদীর দিকে এগিয়ে চলে। আজ থেকে এই বিশাল নদী তার বাড়ি। পুটু মনে মনে গর্ব বোধ করে। মুক্ত জীবনের খুশি নিয়ে পুটু ডুব দেয় নদীর পানিতে।

লেখকঃ মনিরা মিতা 
শিরোমনি,খুলনা।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.