‘আলাদিনের চেরাগ পেলে শৈশবে ফিরে যেতে চাইবো’

গত ২৮ এপ্রিল খ্যাতনামা তথ্য-প্রযুক্তিবিদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, বিশিষ্ট গবেষক ও বিজ্ঞানী, ‘প্রকৌশলীদের গুরু’ বলে খ্যাত জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন। ২০১৭ সালে একটি পত্রিকাকে দেয়া তার সাক্ষাৎকারের উল্লেখযোগ্য অংশবিশেষ মাল্টিনিউজটোয়েন্টিফোর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলোঃ

★ প্রকৌশলী বাড়ি হিসেবে আপনাদের সিলেটের বাড়িটি পরিচিতি ছিল…

জামিলুর রেজা চৌধুরী: আমার বাবা ও তার ভাইসহ পরিবারের প্রায় ১২-১৩ জন সদস্য প্রকৌশলী ছিলেন। বাবা ১৯২৯ সালে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পুরকৌশলে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। সিলেটের জাফলং সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় অংশে তিন পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে যে ঝুলন্ত সেতুটি আছে সেটি আমার বাবার করা। এটি সিলেট অঞ্চলের অন্যতম প্রধান ও প্রথম ঝুলন্ত সেতু।

★ তো শৈশবেই আপনি জেনে যান যে আপনি প্রকৌশলী হবেন…

জামিলুর রেজা চৌধুরী: তা শৈশব থেকেই মোটামুটি ঠিক হয়েছিল যে আমি বড় হয়ে প্রকৌশলী হব।

★ আপনি কি শৈশবে খুব দুষ্টু ছিলেন…

জামিলুর রেজা চৌধুরী: দুষ্টু বলতে যা বোঝায় তা ছিলাম না। তবে শৈশবের দূরন্তপনা তো ছিল। যেমন একটা উদাহারণ দেই। আমাদের সিলেটের বাড়িটা ছিল একটা টিলার উপর। সরকারি চাকরি সূত্রে বাবার একটা গাড়ি ছিল। ঐ গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে আমার খুব সখ্যতা ছিল। সে ড্রাইভিং সিটে বসে আমাকে তার কোলে বসিয়ে রাখতো আর আমি স্ট্রেয়ারিং ধরে থাকতাম। এটা ছিল রোজকার বায়না আমার। একবার আমি গাড়ি খালি পেয়ে একাই উঠে বসি ড্রাইভিং সিটে। এবং কিভাবে যেন গাড়িটা চলতে শুরু করলো। আমি দেখলাম গাড়িটা টিলা থেকে নিচ দিকে নেমে যাচ্ছে। এমন সময় দৌড়ে এসে আমাদের ড্রাইভার আমাকে রক্ষা করেন।

★ বাবার হাতে মার খাওয়ার স্মৃতি মনে আছে কী?

জামিলুর রেজা চৌধুরী: বাবা আমাকে খুব একটা মারধর করেন নি। তবে মনে আছে একবার মেরেছিলেন। আমরা তখন ময়মনসিংহ থাকি। আমার বয়স তখন সাড়ে তিন বছর। আমাদের বাড়ির ওখানে একটা কাঠের মাচা বানানো হয়েছে। সাড়ে সাত ফিটের কাঠের মাচা। তো আমি এবং আরো কয়েকজন বন্ধু মিলে আমরা এটাকে লাফা-লাফি খেলার জায়গা বানিয়ে ফেললাম। আমরা মাচার উপর উঠে নিচে লাফ দিয়ে পড়ি। বাবা দেখে বারণ করলেন কিন্তু শুনলাম না। একদিন বাবা অফিস থেকে ফিরে দেখলেন আমি লাফ দিচ্ছি ঐ মাচার উপর থেকে। তখন তিনি আমাকে ধরে নিয়ে মারধর করলেন। সেই শেষ। আর কোনোদিন এমন হয়নি।

★ প্রকৌশল বাড়ির ছেলে হলেও আপনি তো বড় হয়েছেন একটা সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যেই…

জামিলুর রেজা চৌধুরী: সেই পরিবেশটা আমরা ছোটবেলা থেকেই পেয়েছি। ইঞ্জিনিয়ার মানেই রসকষহীন হতে হবে বিষয়টা এমন না। বাবা বাসায় নিয়মিত দেশ বিদেশের ম্যাগাজিন বই আনতেন। আমি সেগুলো উল্টেপাল্টে দেখতাম। বাড়ির নকশা, ব্রিজের ছবি। আউট বই বেশি পড়তাম। বাবা নিজে বই পড়তেন, আমাদের বই পড়তে দিতেন।

★ ময়মনসিংহে তো আপনার শৈশবের বেশ কিছু সময় কেটেছে…

জামিলুর রেজা চৌধুরী: জীবনের প্রথম স্কুল তো ছিল ময়মনসিংহেই। যদিও আমি ঐ স্কুলে একদিন ক্লাস করেছিলাম। আনন্দমোহন কলেজের পাশেই আমাদের বাড়ি ছিল। বাড়ির সামনে এক বিশাল খেলার মাঠ। শীতকাল আসলেই আমি ব্রহ্মপুত্র নদের ‍বিশাল চরে চলে যেতাম। ঘুরতাম বেড়াতাম। সেই সব স্মৃতি খুব মিস করি। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় চলে আসি আমরা। সেই যে ঢাকায় আসলাম আর ফিরে গেলাম না।

★ ঢাকায় আসার গল্পটা যদি বলতেন…

জামিলুর রেজা চৌধুরী: ট্রেনে করে ময়মনসিংহ থেকে আমরা ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশনে এসে নামলাম। আমাদের জন্য একটা গাড়ি ঠিক ছিল। গাড়িতে করে যেতে যেতে সেদিন দেখছিলাম পল্টন ময়দানে মানুষের ভিড়। ঐ দিন বা পরের দিন খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা দিয়েছেন যে, উর্দু ভাষা হবে রাষ্ট্রীয় ভাষা। এ নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছে। আমরা গোপিবাগের যে বাসাটায় ছিলাম তার পাশেই একটা মাঠ ছিল। ঐ মাঠে নিয়মিত রাজনৈতিক সমাবেশ হত। মিছিল দেখলে পেছন পেছন চলে যেতাম।

★ আপনি তো আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যেই বড় হয়েছেন…

জামিলুর রেজা চৌধুরী: তা বলতে পারো। বাঙালি জীবনের সকল বড় বড় আন্দোলন সংগ্রামের সাক্ষী আমি।

★ আপনার বাসায় প্রচুর বই দেখতে পাচ্ছি। কার কার লেখা পড়তে ভালো লাগে…

জামিলুর রেজা চৌধুরী: ঢাকায় যখন আমরা এলিফেন্ট রোডের বাসায় উঠি, তখন আমি দিনের অধিকাংশ সময় কাটাতাম পাবলিক লাইব্রেরিতে। এখন যেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি তখন এটা ছিল পাবলিক লাইব্রেরি। আমি সকালে নাস্তা করে চলে যেতাম দুপুরে এসে ভাত খেয়ে আবার বিকাল পর্যন্ত লাইব্রেরিতেই থাকতাম। আমার এক বন্ধু ছিল আজিমপুরে থাকতো। আমি বই আনতে ওদের বাসায় চলে যেতাম। বইয়ের পোকা আছে মাথায়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা আমার পছন্দ। বলতে পারো উনি আমার প্রিয় লেখক। তখন গোয়েন্দা সিরিজ পড়তাম খুব। সুবোধ ঘোষের লেখা পছন্দ আমার।

★ একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনি তো দেখতে খুব সুদর্শন। যৌবনে নিশ্চয়ই প্রচুর প্রেমের প্রস্তাব পেতেন…

[প্রশ্নটা শুনে একটু লাজুক হাসলেন। কিছুটা সময় নিয়ে বললেন]

জামিলুর রেজা চৌধুরী: না তেমন ঘটনা নেই আমার জীবনে।

★ আপনার কাউকে ভালো লাগেনি…

জামিলুর রেজা চৌধুরী: প্রেম আমার ছিল, তবে সেটা স্পোর্টসে। আমি যতটা সময় ক্লাসে ছিলাম তারচেয়ে বেশি সময় থাকতাম খেলার মাঠে। সব ধরনের খেলাই খেলতে জানি। ফুটবল, টেবিল টেনিস, ক্রিকেট, হকি। আমি ১৯৭২ সালে ঢাকায় বিলিয়ার্ড চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। ঘোড়া দৌড়াতে জানতাম আমি। খেলাতে বেশি সময় দিয়েছি। আর তখন তো মেয়েদের সঙ্গে দেখাই হত না। আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কোন মেয়ে ছিল না।

★ পদ্মা সেতুর কাজ নিয়েই তো আপনার এখন ব্যস্ততা।

জামিলুর রেজা চৌধুরী: হ্যাঁ। প্রতিদিনই এখন সেতুর কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। এর মাঝে দেশের বাইরে যেতে হবে।

★ ২০১৮ সালের মধ্যে কি কাজ শেষ হবে?

জামিলুর রেজা চৌধুরী: এখনো বলা যাচ্ছে না। হয়তো ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে।

★ সেতু হলে নদীটা কি মারা যাবে না?

জামিলুর রেজা চৌধুরী: নদী মরবে কেনো! যমুনা নদী তো মরেনি। পদ্মাও মরবে না।

★ শেষ প্রশ্ন। যদি এই মূহুর্তে আপনাকে আলাদিনের চেরাগ দেওয়া হয় তার কাছে কি চাইবেন?

[একটু হাসলেন।

জামিলুর রেজা চৌধুরী: একটা জিনিসই চাইবো, যদি সম্ভব হয় আমি আমার শৈশবে ফিরে যেতে চাইবো।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.